আজ || শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫
শিরোনাম :
  যুবদল নেতা মাহবুব হত্যা : খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে আরও দু’জন গ্রেফতার       খুলনায় জামায়াতের বিক্ষোভ – দেশ এখনও ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়নি       পরিস্থিতির জন্য অন্তবর্তী সরকারের নির্লিপ্ততা দায়ী : খুলনা যুবদল       বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা নিরসনে শৈলমারী গেটের পলি অপসারণ শুরু       কুয়েট চালুর দাবিতে ইউজিসি’তে স্মারকলিপি দিয়েছে গার্ডিয়ান ফোরাম       ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে খুলনা ছেড়েছেন এনসিপি নেতারা       আ.লীগ জঙ্গী সংগঠন, গোপালগঞ্জ ফ্যাসিস্টদের আশ্রয় কেন্দ্র; অভিযুক্তদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে       খুলনায় অপহরণ মামলার প্রধান আসামী ছাত্রদল নেতা       কুয়েটে এক বছরের অনিয়ম তদন্তে ইউজিসি’র তদন্ত কমিটি       খুলনার সাথে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল সাড়ে ৪ ঘন্টা    
 


৭নভেম্বরের প্রেক্ষাপট: বাস্তবতা বনাম কল্পকাহিনী।

আমরা তো সবাই জানি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ৩রা নভেম্বর ক্যু হয়েছিল ; কিন্তু কেন হয়েছিল তা কি জানি ? জানি কি এর শেষ পরিণতি?

এ নিয়ে অনেক কল্পকাহিনী, রূপকথা রয়েছে। ইতিহাস ইতিহাসই, কল্পকাহিনী কিংবা রূপকথা দিয়ে তা সাময়িকভাবে ধামাচাপা দেয়া যায় বটে, স্থায়ী পরিবর্তন সম্ভব নয়।

আসুন , প্রকৃত ইতিহাস জানার চেষ্টা করি !
খালেদ- শাফায়ত গংদের বক্তব্য ছিল রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে স্বপরিবারে হত্যাকারী বিদ্রোহী মেজরদের শায়েস্তা করা এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে চেইন অব কম্যান্ড ফিরিয়ে আনার জন্যই তাদের এই ক্যু (চেইন অব কমান্ড ব্রেক করে সেনাপ্রধানকে বন্দী করে চেইন অব অব কমাণ্ড ফিরিয়ে আনা!)
সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ এবং ৪৬ ব্রিগেড কম্যান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের খুব কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন ; অথচ ১৫ আগস্টের ঘটনায় তাদের ভুমিকা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত !
৪৬ ব্রিগেড এর অধিনস্ত ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার এবং ২য় ফিল্ড আর্টিলারি ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটায় অথচ ব্রিগেড কম্যান্ডার বিদ্রোহ দমনে কোন পদক্ষেপ নেয় নি । তিনি সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর কোন নির্দেশ পান নি বলে জানান অথচ ৪৬ ব্রিগেড ছিল স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র যার অধিনে ৪০০০ সৈন্য ছিল । অন্যদিকে সিজিএস খালেদ মোশারফ ছিলেন খুব উৎফুল্ল ।তিনি সহাস্যে ঢাকা সেনানিবাসের ষ্টেশন কমান্ডার লেঃ কর্নেল হামিদের সাথে হাত মিলিয়ে বলেন- ” লুক স্যার, ফ্রিডম ফাইটার্স হ্যাভ ডান ইট বিফোর,এন্ড দে হ্যাভ ডান ইট এগেইন”।ব্রিঃখালেদ এমন ভাব করতে থাকেন যেন এটা তার বিজয় ! তিনি তার আত্মীয় ( ভাগ্নে) ফারুকের গোলাবিহীন ট্যাঙ্কের গোলা সরবরাহ করার জন্য জয়দেবপুর ডিপোকে অর্ডার করেন ।

খন্দকার মোশতাক আহমেদ যখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তখন উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ , ৩ বাহিনীর প্রধানসহ সকলেই তাঁকে অভিনন্দন জানান । ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ মনে করেছিলেন তিনি নতুন সেনাপ্রধান হবেন । বিদ্রোহী মেজরদের অন্যতম নেতা মেজর ফারুক তাঁকে সেই রকম আভাস দিয়েছিলেন । জেনারেল ওসমানী জিয়াকে পছন্দ করতেন না, আর শফিউল্লাহ যে সেনাপ্রধান থাকছে না এটা নিশ্চিত । সুতরাং নতুন সেনাপ্রধান হবার স্বপ্নে বিভোর খালেদ মোশারফ ! কিন্তু ২৪ আগস্ট যখন নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নিয়োগ দেয়া হয় আর দিল্লিতে ট্রেনিঙে থাকা এরশাদকে ডেকে এনে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে প্রমোশন দিয়ে উপ-সেনাপ্রধান নিয়োগ দেয়া হলে ব্রিগেডিয়ার খালেদের সকল আশায় ছাই পড়ে । তাই সে অপেক্ষায় থাকে ক্যু করার ! সেই সুযোগ আসে ৩রা নভেম্বর !
১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কিছু দিনের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এলেও সেনাবাহিনীর ভিতরে চাপা অসন্তোষ চলতে থাকে । সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সাথে জেনারেল ওসমানীর সম্পর্ক ভাল ছিল না । ওসমানীর প্রিয়পাত্র ছিল এরশাদ ; অথচ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করা, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার- সৈন্যদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল চিফ হওয়া , দুর্নীতিবাজ এবং লম্পট চরিত্রের কারণে সবাই এরশাদকে অপছন্দ করতো । মুজিব হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে খুব বেশী প্রতিক্রিয়া না হলেও ফারুক -রশিদদের কর্মকাণ্ডে সিনিয়র অফিসারদের মনে ক্ষোভ জমতে থাকে । তারা সেনাপ্রধানকে আর্মির চেইন অব কম্যান্ড ফিরিয়ে আনার জন্য প্রেশার দিলেও কেউই প্রত্যক্ষ সহায়তা করেনি। আর মোশতাক – ওসমানী – খলিল গংদের প্রশ্রয়ের কারণে সেনাপ্রধানের পক্ষে তা সম্ভবও হয়নি । কারণ প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক জেনারেল ওসমানীকে ডিফেন্স এডভাইজার এবং মেজর জেনারেল খলিলকে চীফ অফ ডিফেন্স স্টাফ নিয়োগ দিয়ে চীফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা সংকুচিত করে দেন।
২রা নভেম্বর সন্ধ্যা হতেই ঢাকা সেনানিবাসের অবস্থা ছিল কিছুটা থমথমে । ক্যু প্ল্যানের সাথে জড়িত অফিসারগণ নিজেদের মধ্যেই সকল কিছু সীমাবদ্ধ রাখে , সাধারণ সৈনিকদের তারা এর মধ্যে রাখেন নি ।
রাত১২.০০-বঙ্গভবনঃ
রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের সাথে মিটিং করছিলেন জেনারেল ওসমানী , মেজর জেনারেল খলিলসহ মন্ত্রীপরিষদের কয়েকজন সদস্য । আর অবধারিতভাবে লেঃ কর্নেল রশিদ ! এসময় এক পুলিশ অফিসার এসে খবর দেয় যে বঙ্গভবনের পাহাড়ায় নিয়োজিত সব আর্মি চলে গেছে । নিশ্চিত ঝড়ের লক্ষন বুঝে সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায় লেঃকর্নেল ফারুক তার ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাঙ্কবহর আর মেজর রশিদ তার ২য় ফিল্ড আর্টিলারির কামান প্রস্তুত করে ।
রাত ১২.০০ ঢাকা সেনানিবাসঃ
১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহকে এক প্লাটুন সৈন্য দিয়ে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসভবনে প্রেরণ করা হয় । তারা বাসার গার্ডদের সরিয়ে দেয় এবং টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে । হাফিজুল্লাহ সেনাপ্রধানের ড্রয়িং রুমে ঢুকে স্যালুট দিয়ে বলে – স্যার,ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের নির্দেশে আপনাকে বন্দী করা হল । সেনাপ্রধান কিছুটা বিস্মিত হয়ে জানতে চান শাফায়াত জামিল কোথায় ? হাফিজুল্লাহ বলে তিনি ৪র্থ বেঙ্গলে ব্রিঃ খালেদের সাথে আছেন । জিয়া কর্নেল আমিনুলের কথা জিজ্ঞেস করলে হাফিজুল্লাহ জানায় ব্রিঃ খালেদ নিজেই ৪র্থ বেঙ্গল কম্যান্ড করছেন তবে কর্নেল আমিনুল ঠিক আছেন ।জিয়া এসময় গভীর ভাবনায় তলিয়ে যান । তিনি কি যুদ্ধ দিনের কথা ভাবছিলেন ? ভাবছিলেন জেড ফোর্স , ১ম বেঙ্গল , ৩য় বেঙ্গল আর ৮ বেঙ্গলের কথা ? ভাবছিলেন নিজের প্রিয় সহযোদ্ধা জিয়াউদ্দিন , শাফায়াত জামিল , আমিনুলদের কথা ! সকালবেলায় সেনাপ্রধান জিয়ার বাসায় হাজির হন লগ এরিয়া কমান্ডার কর্নেল মইনুল হোসেন চৌধুরী। রাতে তার বাসায় টেলিফোনে একটি মহিলা কণ্ঠের উদ্বিগ্ন আওয়াজ পান, ভাই কি হচ্ছে এসব? সেনারা আমাদের হাউস অ্যারেস্ট করছে কেন? লাইনটা কেটে যাওয়ায় তিনি বুঝতে পারেননি কে ফোন করেছিল, পরে অবশ্য বুঝতে পারেন ফোন করেছিলেন বেগম জিয়া। সকালে উঠেই কর্নেল মইন ফুল ইউনিফর্ম পরে লাঠিতে ভর দিয়ে সেনাপ্রধানের বাসায় যান। সেনাপ্রধানের বাসভবনের উল্টোদিকের বাসায় তিনি থাকতেন। কিছুদিন আগে বাস্কেটবল খেলতে গিয়ে তিনি পা ভেঙ্গেছেন। সেনাপ্রধানের বাসায় ঢুকে ড্রইংরুমে ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহকে দেখে কড়া ধমক দেন এবং সবাইকে গেটের বাহিরে গিয়ে অবস্থান করতে বলেন। সেনাবাহিনীতে কর্নেল মইন কড়া মেজাজ এবং কঠিন শৃঙ্খলাপরায়ণ অফিসার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ গেটের বাহিরে অপেক্ষা করলেন না, এক দৌড়ে চলে গেলেন বিঃখালেদের কাছে। কর্নেল মইনকে দেখে সেনাপ্রধান কিছুটা অবাক হলেন। মইন সোজা ভিতরে গিয়ে বেগম জিয়াকে বলেন ছেলেদের দ্রুত নাস্তা খাইয়ে স্কুলের জন্য রেডি করে দিতে। এরপর তিনি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলেন এবং সেনাপ্রধানের দুই ছেলেকে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দিয়ে তিনি যান ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের খোঁজে। বন্দী সেনাপ্রধানের বাসায় তার প্রবেশ এবং বিনা বাধায় বাচ্চাদের স্কুলে প্রেরণ দেখে তিনি বুঝতে পারেন এই ক্যু যথেষ্ট প্লান -পেপারওয়ার্ক ছাড়াই সংঘটিত হয়েছে। ৪র্থ বেঙ্গলে গিয়ে তিনি ব্রিগেডিয়ার খালেদসহ অনেক সিনিয়র অফিসারকে পান। কর্নেল মইনকে দেখে সবাই অস্বস্তি বোধ করেন। প্রচন্ডরকম নিয়মানুবর্তী কর্নেল মইন এই বিদ্রোহে থাকবেন না স্বাভাবিক, কিন্তু তিনি সেনাপ্রধানের পক্ষে অবস্থান নিবেন কিনা? লগ এরিয়া কমাণ্ডার হিসেবে যদিও তার শক্তি তেমন নেই, কিন্তু ২য় বেঙ্গল যে তার অতি বিশ্বস্ত । আশার কথা পা ভেঙ্গে তিনি প্রায় অচল!

সেনাপ্রধানকে গৃহবন্দী করে খালেদ মোশারফ ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনা মোতায়েন করেন ।
সেনাপ্রধান জিয়াকে বন্দী করে ব্রিঃ খালেদ মোশারফ ফারুক- রশিদ গং মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করেন ।
# ৪র্থ বেঙ্গলের ২টি কোম্পানি কাওরান বাজার এলাকায় মোতায়েন করা হয় বঙ্গভবন হতে সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ।
# ৪র্থ বেঙ্গলের ১টি কোম্পানি এন্টি ট্যাঙ্ক রকেট নিয়ে অবস্থান নেয় মেজর ফারুকের ট্যাঙ্ক বহর মোকাবেলা করার জন্য ।
# ২য় বেঙ্গলের ১টি কোম্পানি পাঠিয়ে রেডিও স্টেশন দখলে নেয়া হয় এবং সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয় ।
# ১ম বেঙ্গলের ২ টি কোম্পানি বঙ্গভবন এর আশে পাশে অবস্থান নেয় ।
# ১ম বেঙ্গলের ১ টি কোম্পানি তেজগাঁ বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে ।
# ৪৬ ব্রিগেডের অন্যান্য ইউনিট ঢাকা সেনানিবাস এবং শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোতায়েন করা হয়।
# রংপুরে অবস্থিত ৭২ ব্রিগেড কম্যান্ডার কর্নেল কে এন হুদা (খালেদ মোশারফের আত্মীয় এবং বিশ্বস্ত) সবার অলক্ষ্যে এবং অজান্তে ১০ এবং ১৫ বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন ।

সকালবেলা বিমান বাহিনী প্রধান খালেদ মোশারফের সাথে যোগ দেন । তার নির্দেশে ২টি মিগ এবং ২টি হেলিকপ্টার অস্ত্র সজ্জিত হয়ে বঙ্গভবন এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উপর দিয়ে মহড়া দিতে থাকে ।

অন্যপক্ষ বঙ্গভবন , সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং সেনানিবাসে পূর্ণ অস্ত্র সজ্জিত হয়ে আক্রমণাত্মক অবস্থান নেয় । ফারুক – রশিদের ট্যাঙ্ক এবং কামান ছিল গোলা পূর্ণ ; ১৫ আগস্ট এর মতো ফাঁকা ছিল না !বঙ্গভবনের উপর দিয়ে বিমানের উস্কানিমূলক তৎপরতাকে ফারুক চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে গুলি করে ভুপাতিত করার অনুমতি চায় জেনারেল ওসমানীর নিকট । ওসমানী তাকে অতি কষ্টে সামাল দেয় ।

এদিকে কর্নেল শাফায়াত জামিল খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে । সকাল হতেই তিনি ক্যাপ্টেন তাজকে জিয়ার বাসার পাহারায় নিযুক্ত করেন । শাফায়াত জামিল ব্যক্তিগতভাবে জিয়াকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন । যুদ্ধের সময় তিনি জিয়ার অধীনে জেড-ফোর্সের ৩য় বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন । খালেদ মোশারফ বিষয়টি জানতেন বলেই রংপুর হতে ৭২ব্রিগেডকে ঢাকায় আসার নির্দেশ দেন ; শাফায়াত জামিলের উপর তিনি পুরোপুরি আস্থাশীল ছিলেন না ।

সকালবেলা রেডিও বন্ধ পেয়ে দেশবাসীর মনে এক অজানা আশংকা দেখা দেয় ।
# ২৬ মার্চ,১৯৭১ রেডিও বন্ধ ছিল ।
# ১৫, আগস্ট রেডিও বন্ধ ছিল ।
সবার মনে এক চাপা আতংক , কি হল ! কি হল !

৩রা নভেম্বর সারাদিন বঙ্গভবন -সেনানিবাস টেলিফোন যুদ্ধ চলে ব্রিঃখালেদ -লেঃকর্নেল রশিদ , জেনারেল ওসমানী -ব্রিঃ খালেদ , খন্দকার মোশতাক -ব্রিঃখালেদ ! খালেদের প্রস্তাব ছিল –
১। বিদ্রোহী সকল ফোর্স ট্যাঙ্ক ও কামানসহ সেনানিবাসে ফেরত পাঠাতে হবে ।
২। সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অপসারন করতে হবে ।
৩। মন্ত্রিসভাসহ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পদত্যাগ করতে হবে ।

এক পর্যায়ে লেঃকর্নেল ডালিম ও মেজর নুর বঙ্গভবনের পক্ষ হতে সেনানিবাসে আসেন নেগসিয়েশনের জন্য । প্রস্তাব -পাল্টা প্রস্তাব চলতেই থাকে । ব্রিঃ নুরুজ্জামান এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল উত্তেজিত হয়ে প্রস্তাব দেয় অবিলম্বে খন্দকার মোশতাককে গ্রেপ্তার করা হোক ; কিন্তু খালেদ রাজী হন নি । অন্যদিকে জেনারেল ওসমানী সবাইকে অনুরোধ করছেন যে কোন মূল্যে গৃহযুদ্ধ এড়াতে ।
আলোচনার এক প্রেক্ষিতে চতুর মোশতাক ব্রিঃ খালেদকে বলেন আলোচনায় যদি সমাধান না আসে তাহলে আগামী কাল আমি পদত্যাগ করব এবং “একটা রিক্সা ডাইকা আগামসি লেনে যামুগা! ” আর এ অবস্থায় যদি কিছু ঘটে তবে দায় দায়িত্ব খালেদের । খালেদ এবার ফাঁদে পড়ে । রাষ্ট্রপতি না থাকলে তাকে নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেবে কে ?
এমতাবস্থায় জেনারেল ওসমানীর পরামর্শ উভয় পক্ষ মেনে নিয়ে সম্ভাব্য রক্তপাত এড়িয়ে যায় ।
# ফারুক -রশিদ গং এর যারা দেশ ছেড়ে যেতে চাইলে তাদের যাবার ব্যবস্থা করা হবে ।
# ট্যাঙ্ক এবং কামানসহ অবশিষ্ট ফোর্স সেনানিবাসে ফিরে যাবে ।
# সেনাপ্রধান স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেছেন এই মর্মে লিখিত আবেদন পেলে রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করবেন ।
# আপাতত খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকবেন ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসারগণ অনেক পরিশ্রম করে ফারুক -রশিদ গংদের সকল কাগজপত্র রেডি করে । অবশেষে রাত ৮.৪৫ ঘটিকায় তেজগাঁ বিমানবন্দরে ফারুক- রশিদ গংএর ১৭ জন সদস্য সস্ত্রীক বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ বিমানে করে ঢাকা তাগ করে এবং চট্টগ্রামে ফুয়েল নিয়ে সরাসরি ব্যাংকক চলে যায় ।

ব্রিঃখালেদের ক্যু এবং বঙ্গভবন – ক্যান্টনমেন্ট আলোচনার মধ্যে সবার অজান্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা । কারাবন্দী ৪ জন জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ , সৈয়দ নজরুল ইসলাম , ক্যাপ্টেন(অবঃ) এম মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় । ব্রিঃ খালেদ গং ক্ষমতা দখলের জন্য ব্যাকুল, অন্যদিকে জেলখানায় তখনো ৪নেতার লাশ পড়ে আছে !

এই সমস্ত দাবী দাওয়া নিয়ে যখন কথা চলছিল তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সবার অলক্ষ্যে ঘটে এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড । ৪ জন জাতীয় নেতাকে বন্দী অবস্থায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় । ক্ষমতা লিপ্সু খালেদ গং তখন ক্ষমতায় যাওয়ার মোহে বিভোর !
৩ তারিখ রাতে সবার মধ্যে যে স্বস্তি এসেছিল ৪ তারিখ সকালেই তা পাল্টে যায় । পুলিশের ডি.আই.জি ইআই চৌধুরীর নিকট জেল হত্যার খবর শুনে খালেদ মোশারফ উত্তেজিত হয়ে উঠে । তিনি বলতে থাকেন , আগে কেন কেউ আমাকে জানালো না ? আমি খুনিদের দেশ ত্যাগ করতে দিতাম না !
যে লোক শেখ মুজিবের আত্মস্বীকৃত খুনিদের নিরাপদে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেয় ; তিনি ৪ নেতার জন্য খুব বেশী কিছু করবেন তা বিশ্বাসযোগ্য ? আসলে মানুষ ক্ষমতার মোহে কেমন অন্ধ হয়ে যায় তার প্রমান খালেদ মোশারফ !

এখন আর ফারুক- রশিদ গং নেই , ট্যাঙ্ক -কামানের ভয় নেই ; সুতরাং খালেদ মোশারফ নিজেকে সবচাইতে ক্ষমতাধর মনে করলেন । তারা সদলবলে বঙ্গভবনে গিয়ে হুমকি ধামকি দেয়া শুরু করলেন ! তারা অবিলম্বে খালেদ মোশারফকে সেনাপ্রধান বানানোর চাপ দিতে থাকে ।খন্দকার মোশতাক আহমেদ বলে সেনাপ্রধানের পদত্যাগ পত্র না পেলে তিনি কিছু করতে পারবেন না ।
এবার সেনাপ্রধান জিয়ার পদত্যাগপত্র ঘোষণা আনতে হবে ! শাফায়াত জামিল আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি সেনাপ্রধানের মুখোমুখি হতে পারবেন না ! খালেদ নিজে জিয়ার সামনে যাবেন সেই মনোবল তাঁর নেই । অনেক সিনিয়র অফিসার ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে সরে রইলেন যেন তাদেরকে সেনাপ্রধানের কাছে না পাঠানো হয় । শেষ পর্যন্ত ব্রিঃ রউফ ও লেঃ কর্নেল আনোয়ারকে পাঠানো হল । সেনাপ্রধান জিয়া তাদের সাথে কথা না বাড়িয়ে পদতাগপত্র স্বাক্ষর করে দেন এবং সেইসাথে তাঁর পূর্ণ পেনশন এর স্মরণ করিয়ে দেন ! মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, স্বাধীনতার ঘোষক , জেড-ফোর্সের দুর্ধর্ষ কম্যান্ডার , সেনাপ্রধানের মুখে পেনশনের কথা শুনে উভয় অফিসারের মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে । তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য জানত সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান কতটা সৎ ছিলেন – কি পরিমান সাধারণ জীবন যাপন করতেন ! তারা বিষয়টি দেখবেন বলে স্যালুট দিয়ে বিদায় নিলেন ।

খালেদ মোশারফ এবার রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে বলেন তাকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য । কিন্তু মোশতাক তাকে জানান একজন ব্রিগেডিয়ার বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সেনাপ্রধান হতে পারেন না । সেই জন্য প্রথমেই তাকে মেজর জেনারেল পদে প্রমোশন দিতে হবে । আর এই প্রমোশন মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয় ।

সারাদিন বঙ্গভবনে নানা ধরনের মিটিং চলতে থাকে কিন্তু কোন বিষয়ের সুরাহা হয় না । এর মধ্যে খালেদ মোশারফের মা এবং ভাই রাশেদ মোশারফের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঢাকায় একটি মিছিল করে যা খালেদের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায় !

বঙ্গভবনে খালেদ যখন ক্ষমতার দেন দরবার নিয়ে ব্যস্ত তখন সেনানিবাসসহ ঢাকা শহর -সারাদেশে নানা ধরনের গুজব ! দেশবাসীর মনে প্রশ্ন , কি হচ্ছে দেশে ? আর সেনা সদস্যদের মধ্যে এক্তাই কথা – জেনারেল জিয়া বন্দী কেন ? কেন ? কেন? জিয়ার সততা , দেশ প্রেম, নিয়মানুবর্তীতা আর বিলাসবর্জিত অতি সাধারণ জীবনযাপন সবাই জানতেন । তাই তাঁকে বন্দী করে পদত্যাগ পত্র আদায় কেউ ভাল চোখে দেখেনি ।

অন্যদিকে চলছে আরেক রাজনৈতিক খেলা । শেখ মুজিবের শাসনামলে হত্যা , গুম আর নির্যাতনের শিকার জাসদ এবার কিছু করার প্ল্যান করে । দেশে যেহেতু রাজনৈতিক শুন্যতা চলছে,সুতরাং এটাই হল মোক্ষম সময় । তৎপর হয়ে উঠেন লেঃ কর্নেল(অবঃ) তাহের ,তৎপর হয়ে উঠে গণবাহিনী ,তৎপর হয়ে উঠে বিপ্লবী সেনা সংস্থা ! ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে বাহিরে চলতে তাহকে নানা ধরনের ততপরতা । ক্ষমতার মোহে অন্ধ খালেদ মোশারফ এসব কিছুই জানল না বা জানার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি ।

বঙ্গভবনের দেরি দেখে সাফায়াত জামিল খুব উত্তেজিত হয়ে উন্মুক্ত স্টেনগান নিয়ে মন্ত্রিসভার মিটিং রুমে প্রবেশ করে । তাঁর এই রণমূর্তি দেখে অনেকেই ভয় পেয়ে টেবিলের নীচে লুকিয়ে পড়ে । খালেদ মোশারফকেও তিনি দোষারোপ করতে থাকেন । জেনারেল ওসমানী পরিস্থিত শান্ত করে সবাইকে নিয়ে পুনরায় আলোচনায় বসেন । আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় খালেদ মোশারফকে মেজর জেনারেল হিসেবে প্রমোশন দিয়ে সেনাপ্রধান বানানো হবে , মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত , নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেয়া হবে । রাত ২.০০ ঘটিকায় মিটিং শেষ করে সবাই বাড়ি যায় কেবল ৪ জন ছাড়া ।তারা হলেন – শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন , তাহের উদ্দিন ঠাকুর , কে এম ওবায়দুর রহমান ও নুরুল সিলাম মঞ্জুর ; তাদের জেলে পাঠানো হয় !
রাতেই বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল তোয়াব এবং নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম এইচ খান খালেদ কে মেজর জেনারেল র‍্যাঙ্ক পরিয়ে দেন ।

৫ নভেম্বর ঊর্ধ্বতন সামরিক বেসামরিক অফিসারদের আর্মি হেডকোয়ার্টারে মিটিং এ ডাকা হয় । আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল কিভাবে আইনগত এবং শান্তিপূর্ণ ভাবে রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদের কাছ থেকে নতুন রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায় । সারাদিন বিভিন্ন প্ল্যান প্রোগ্রাম চলতে থাকে । প্রধান বিচারপতি সায়েম প্রথমে রাষ্ট্রপতি হতে রাজী হন নি । দেশের এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কেই বা হতে চায় ! খালেদ মোশারফের অনেক অনুনয় এবং আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তিনি রাজী হন ।
রাত ১০..০০ ঘটিকায় খালেদ মোশারফ নৌ এবং বিমান বাহিনীর প্রধানকে সাথে নিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদের পদতাগপত্র ( অসুস্থতার কারণে) এবং অন্যান্য কাগজপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে আসেন।

৬ তারিখ দেশের ৬ষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন বিচারপতি সায়েম । বঙ্গভবনে জমকালো অনুষ্ঠান, চারিদিকে কেবল ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ আর টেলিভিশন ক্যামেরার ছবি ধারণ । রাষ্ট্রপতি সায়েম আর খালেদ মোশারফ হাসিমুখে সবার সাথে হাত মেলাচ্ছেন উপস্থিত সকল সামরিক – বেসামরিক ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সাথে ।

অন্যদিকে ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠছে । জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা লিফলেট বিতরন করে চলছে ।জেসিও এবং সাধারণ সিপাহীরা খুব উত্তেজিত ! কর্নেল আমিনুল হক পুনরায় ৪র্থ বেঙ্গলের কমান্ডিং গ্রহণ করেন । মেজর রশিদের ২ ফিল্ড আর্টিলারিতে তখন তুমুল উত্তেজনা ।

এরই মাঝে আরেকটি ঘটনা খালেদ মোশারফের বিরুদ্ধে যায় তা হল – ভারতীয় দুতাবাসের সামরিক এ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার ভোরা সেনানিবাসের গেটে খালেদের জন্য একটি প্যাকেটে একসেট সামরিক পোশাক রেখে যান যা ছিল ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অনুরোপ । খালেদ মোশারফের এই ক্যু এমনিতেই মানুষ ইন্ডিয়ার হাত আছে বলে সন্দেহ করতো , এই ঘটনা সবার সন্দেহ আরও দৃঢ় করে ।

চারিদিকে যখন নানা গুঞ্জন , ফিসফাস আলোচনা খালেদ মোশারফ কিন্তু তখন বঙ্গভবনে ব্যস্ত বইপত্র আর নানা রেফারেন্স ঘাটাঘাটি করে । তাঁকে কেন CMLA ( chief marshal law administrator ) করা হবে না ? একজন সিভিলিয়ন রাষ্ট্রপতি হবে CMLA , আর তাঁকে থাকতে হবে তাঁর আন্ডারে ! অসম্ভব ! তিনি তখন আইয়ুব খান সহ অন্যান্য রেফারেন্স দেখান । খালেদের এই অহেতুক বিলম্ব দেখে শাফায়াত জামিল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে । সে অবিলম্বে রেডিও -টিভিতে মার্শাল’ল জারির করতে বলেন । এদিকে খালেদ কিছুতেই DCMLA হতে রাজী হচ্ছিলেন না ; বিশেষ করে ক্ষুদ্র নেভি আর এয়ার চিফ তাঁর সাথে DCMLA হবে ? সবাই খালেদ মোশারফকে বুঝান আপাতত President সায়েম CMLA থাকুন , পরিস্থিতি শান্ত হলে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে । সবার প্রেশারে খালেদ মোশারফ রাজী হয়ে বলে , ওকে ওকে , তাই কর । তোমরা সবাই যা বুঝ তাই কর ।আজ সকল পেপার তৈরি কর , কাল রেডিও – টিভিতে ঘোষণা হবে ! সত্যি কি তাই ! আগামী কাল যে তাঁর শেষ কাল তা যদি তিনি জানতেন !রাত তখন ১১.০০ ঘটিকা ।

অন্যদিকে ক্যান্টনমেন্টে তখন ভিন্ন অবস্থা ! সর্বত্র চাপা উত্তেজনা ! ২ ফিল্ড আর্টিলারি প্রস্তুত , প্রস্তুত বিভিন্ন ইউনিট , প্রস্তুত কিছু বেসামরিক মানুষও ! প্রস্তুত কর্নেল আমিনুল আর ক্যাপ্টেন মুনিরের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের বিশ্বস্ত সৈনিকেরা ! জওয়ানরা প্রস্তুত H-hour এর সিগন্যালের জন্য – সবাই তখন চোয়ালবদ্ধ , দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ! লক্ষ আপাতত একটাই জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা ! অধীর প্রতীক্ষায় সবাই চরম মুহূর্তের জন্য ।

রাত ১২.০০ বঙ্গভবনঃ
খালেদ মোশারফ বসে মিটিং করছেন সাথে শাফায়াত জামিল , লেঃ কর্নেল মালেক , লেঃ কর্নেল হুদা , লেঃ কর্নেল হায়দার ( খালেদের ডাকে চট্টগ্রাম হতে রাতে এসে পৌঁছান) প্রমুখ অফিসার । তারা সেনা বিদ্রোহের কোন খবর পর্যন্ত জানেন না ! এসময় একটি টেলিফোন আসে ৪৬ ব্রিগেড হতে , অপর প্রান্ত হতে একজন জানায় সৈনিকেরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে , তারা অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে সকল অস্ত্র বের করে নিয়ে গেছে আর অবিরাম ফায়ার করছে । খালেদ বুঝতে পারলেন তাঁর খেলা শেষ – কেউ পাল্টা ক্যু করেছে । সঙ্গে সঙ্গে সবাই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হলে পালাতে লাগলো ! খালেদ তাঁর প্রাইভেট কারে চড়ে হুদা আর হায়দারকে সাথে নিয়ে প্রথমে কলাবাগানে তাঁর এক আত্মীয়র বাসায় গিয়ে সামরিক পোশাক পাল্টে কিছুক্ষন পরিস্থিতি বুঝেন । অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন শেরে বাংলানগরে অবস্থিত ১০ বেঙ্গলে যাবেন । ১০ বেঙ্গল হচ্ছে হুদার নিজস্ব ব্যাটালিয়ন যা যুদ্ধের সময় খালেদের কে- ফোর্স এর অধীনে যুদ্ধ করেছে । এটাই এই মুহূর্তে সবচাইতে নিরাপদ ! কিন্ত কে ভেবেছিল এই নিরাপদ আশ্রয়েই তাঁর এবং হুদা -হায়দারের জীবনাবসান হবে !

শাফায়ত জামিল বঙ্গভবনে একটি রুমে বিস্রাম নিচ্ছিলেন, বিদ্রোহী সিপাহিদের তাড়া খেয়ে বঙ্গভবনের উঁচু দেয়াল টপকাতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেন এবং মুন্সিগঞ্জ থানায় আশ্রয় গ্রহণ করেন । পরদিন জিয়াউর রহমান সংবাদ পেয়ে এ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে CHM ভর্তি করানোর ব্যবস্থা নেন ।
মালেক তাঁর স্টাফ কার নিয়ে সাভারের দিকে চলে যান ১০ বেঙ্গলে আশ্রয় নেয়ার জন্য , কিন্তু তিনি জানতেন না সন্ধ্যায় ১০ বেঙ্গল ঢাকায় পৌঁছে গেছে । অনেক খুজেও তিনি কারো কোন হদিস না পেয়ে নিজ বাড়ি মানিকগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেন । মানিগঞ্জের সন্নিকটে এসে তাঁর গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেলে তিনি হেঁটেই বাড়ি পৌঁছে প্রান বাঁচান !
মেজর হাফিজ সৈনিকদের তাড়া খেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বনানীতে অবস্থিত ১ম বেঙ্গলে পৌঁছে জীবন বাঁচান !

আরেকদিকে জেনারেল জিয়াকে কেন্দ্র করে ক্যান্টনমেন্টে এক ভিন্ন চিত্র ! লাইট এ্যাক এ্যাক গান গর্জে উঠে বিদ্রোহের সংকেত দেয় – সারা ক্যান্টনমেন্ট যেন একসাথে জেগে উঠে ! চারিদিকে শুধু গুলির শব্দ আর ট্রেসার এর আলো ! সবাই শ্লোগান দিচ্ছে – আল্লাহ্‌ আকবর ! বাংলাদেশ – জিন্দাবাদ ! জেনারেল জিয়া -জিন্দাবাদ ! সুবেদার মেজর আনিসের নেতৃত্বে একদল সৈনিক জেনারেল জিয়াকে বন্দীদশা হতে মুক্ত করে এবং কাঁধে চড়িয়ে ২ ফিল্ড আর্টিলারিতে নিয়ে আসে । বেগম জিয়া বেলকনিত দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করেন আনন্দাশ্রু নিয়ে।
২ফিল্ড আর্টিলারীতে অফিসার বলতে কেবল কর্নেল আমিনুল আর ক্যাপ্টেন মুনির( তাজউদ্দীনের মেয়ের জামাতা) । জেনারেল জিয়া সেখান হতে বিভিন্ন অফিসারদের খবর পাঠাতে থাকেন । উপ-সেনাপ্রধান এরশাদের বাসভবনে সৈনিকেরা তাকে ডাকতে গেলে তিনি ভয়ে বোরকা পরে পালিয়ে যান।
ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী ভয়ে আলমারিতে লুকিয়ে থাকেন। ক্যাপ্টেন মুনির বার বার বলতে থাকেন যে জেনারেল জিয়া আবার কমাণ্ড গ্রহণ করেছেন। এরপর মুনিরের নিকট নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে তিনি বাহির হন। সকালবেলায় ধীরে ধীরে উপস্থিত হতে থাকেন সিনিয়র অফিসারগণ।
এভাবেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় খালেদ মোশারফের ৫ দিনের বিদ্রোহ !
চারিদিক প্রকম্পিত জেনারেল জিয়া – জিন্দাবাদ ধ্বনিতে ! শুরু হয় সিপাহি -জনতার মহান বিপ্লব !
সুত্রঃ
১। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও না বলা কিছু কথা – লেঃ কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি(অবঃ)।
২। এক জেনারেলের নীরব স্বাক্ষ্যঃস্বাধীনতার প্রথম দশক – মেজর জেনারেল (অবঃ)মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম।
৩। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য অগাস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর- কর্নেল(অবঃ) শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম।
৪। বাংলাদেশঃ এক রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫৮১ – ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) এম সাখাওয়াত হোসেন।
৫। মিশ্র কথনঃ মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, বীর প্রতীক।

৬। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব:) মো:আমিনুল হক এর সাক্ষাৎকার।

লেখক:মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান জুয়েল। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাস গবেষক।


Top