মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি সারা বিশ্বের কাছে এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য হিসেবে চিহ্নিত। পরীক্ষিত মিত্রদের বিপদের দিনে ছেড়ে যায় না। আবার যাদের ধ্বংস করতে চায়, তারা ধ্বংস হওয়ার আগে টেরও পায় না।
মার্কিনীদের পুরনো মিত্র হচ্ছে ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্ব। মিত্রদের বাঁচাতে দুই বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন ভুমিকা অসামান্য। অন্যকথায় বলতে গেলে অপ্রতিরোধ্য অক্ষশক্তিকে মার্কিন সহায়তা ছাড়া ঠেকানো সম্ভব ছিল না।
ব্রিটিশ এবং অন্যান্য ইয়োরোপীয় দেশের প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে প্যালেস্টাইন ভুমিতে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্ম হলেও তা লালন পালন করে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চারিদিকে মুসলিম দেশ পরিবেষ্টিত ইসরাইল টিকে আছে মার্কিন সমর্থনে। সারা বিশ্ব এবং জাতিসংঘের চাপ উপেক্ষা করেই তারা ইসরাইলকে সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমর্থন ও সহায়তা দিয়ে আসছে।
একই কথা তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সুপার পাওয়ার চীনকে অবজ্ঞা করে তারা তাইওয়ানের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। একই কথা দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি অবশ্য ভিন্নভাবে পরিচালিত হয়। তবে মার্কিন স্বার্থ নষ্ট হলে কিংবা সম্মানহানি হলে তারা যে কোন উপায়ে প্রতিশোধ নেবেই। ব্রিটিশ রাজ বিদায় নেয়ার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র ২টি আলাদা ব্লকে চলে যায়। নেহেরুর ভারত ছিল কমিউনিস্ট ব্লকের ঘনিষ্ঠ মিত্র যদিও তারা ওয়ারশ জোটে যোগদান করেনি।
অন্যদিকে পাকিস্তান ছিল মার্কিন ঘেঁষা। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এবং প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান মার্কিন মিত্র হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
এরপর গঙ্গা সিন্ধুনদ দিয়ে বহু পানি বঙ্গোপসাগর আর আরব সাগরে পতিত হয়েছে। ভারত, পাকিস্তানের পর দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় শক্তিশালী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা ভারতের সহায়তা ছাড়া অসম্ভব না হলেও দীর্ঘতর ও কঠিন যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হতো। যুদ্ধের পর বাংলাদেশের উপর ভারতের একক প্রভাব লক্ষ্যনীয়। তবে ১৯৭৫ এর পর ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান শক্তিশালী অবস্থান তৈরী করতে চেয়েছিলেন। তিনি মুসলিম, চীন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দেশসমূহের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন যা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তিনি জীবন দিলেও বিদেশি আধিপত্যের কাছে মাথা নত করেন নি।
১৯৭১ সালে পূর্বপাকিস্তান আলাদা হয়ে গেলেও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন ও চীন ঘেঁষাই থেকে যায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট ব্লকের বিরুদ্ধে মার্কিন বলয় এবং আঞ্চলিক ক্ষেত্রে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই দক্ষিন এশিয়ায় আগ্রাসী ছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তা নেহেরুর সময় জোট নিরপেক্ষ হলেও ইন্দিরারা সময় ক্রমশঃ তা সোভিয়েত ব্লকে ঝুঁকে পড়ে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমা বিশ্ব ভারতে অর্থনৈতিক সহায়তা বাড়ালেও রাজনৈতিক উত্থান ঘটতে দেয়নি। আবার চায়নাকে ঠেকানোর জন্য ভারতকে শক্তিহীনও করেনি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারা দু’টি ভাগে বিভক্ত। বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা ইন্ডিয়ার প্রতি চরমভাবে অনুগত। অন্যদিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বিএনপি ইন্ডিয়া বিরোধী হিসেবে পরিচিত। তাই দেখা যায় আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভারত যতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, বিএনপির আমলে তা হয়না।
তাই বিএনপি যতবার নির্বাচিত হয়েছে, ইন্ডিয়ার সাথে সম্পর্ক চুড়ান্ত পর্যায়ে উষ্ণ হয়ে ওঠেনি। এর মূল্য অবশ্য ১/১১ এর মাধ্যমে বিএনপিকে দিতে হয়।
শুরু হয় বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার একাধিপত্য। মার্কিন ও চাইনিজ স্বার্থ হটিয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইন্ডিয়ান প্রভাব ওয়ান এন্ড অনলি হয়ে যায়। মার্কিন স্বার্থ তো দূরের কথা বাংলাদেশে তারা ন্যুনতম সম্মান পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হতে থাকে। পর পর তিন মেয়াদে ক্ষমতা দখল করে এবং ইন্ডিয়ার অল আউট সমর্থন পেয়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম হয়৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সারাবিশ্বে একক সুপার পাওয়ার তা শেখ হাসিনা যেন ভুলে যায়। মার্কিন সহায়তা হতে বাংলাদেশ নানাভাবে বঞ্চিত হলে ব্যক্তি শেখ হাসিন ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগ চরম মার্কিন বিরোধিতা শুরু করে। কূটনৈতিক ভাষা পরিহার করে তারা নানা অপমানজনক কথা ও আচরণ শুরু করে।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে সব জায়গায় সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া না দেখানো। তারা দীর্ঘ সময় নিয়ে অনুকূল পরিবেশ আসার অপেক্ষায় থাকে অন্য কথায় অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
সদ্য বিজয়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে ইন্ডিয়া এবং আওয়ামী লীগ মনে করছে বাংলাদেশের সরকার প্রধান মু: ইউনুসের অবসান ঘটতে চলতে। তারা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বুঝতে এখনো ব্যর্থ। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মার্কিনীরা যাদের একবার সমর্থন দেয়, চরম বিরোধিতা না করলে তারা সমর্থন প্রত্যাহার করেনা।
কানাডায় শিখ নেতা হত্যা এবং আমেরিকায় শিখ নেতা হত্যাচেষ্টার সাথে “র” এর নাম চলে আসায় মার্কিন, -ভারত সম্পর্ক যথেষ্ট শীতল। তার উপর সম্প্রতি রাশিয়ায়-চীন – ভারতের মধ্যে যে গোপন চুক্তি হচ্ছে তা নিশ্চয়ই মার্কিনীদের অজানা নয়।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানো বা চাপ দেয়ার কৌশল যাই হোক না কেন সেটা বাইডেন, ট্রাম্প কেন কোন খাঁটি ভারতীয় যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়, তবুও পররাষ্ট্রনীতি চুল পরিমাণ বদল হবেনা।
মার্কিন স্বার্থবিরোধী হওয়ায় ইমরান খানের সরকার পতন হয়ে গেলো। আবারো যদি মার্কিনীদের মনে হয় ইন্ডিয়া তাদের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করবেনা, তাহলে পাকিস্তানকে পুনরায় সহায়তা দেয়া শুরু করবে।
শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ ব্যক্তি বাইডেনের নয় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ব্লাকলিস্টে আছে। তাই ট্রাম্প ইচ্ছে করলেই প্রফেসর মু: ইউনুসকে সরিয়ে পুনরায় শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসাবে, এটা চিন্তা করা শুধু শিশুতোষ ভাবনা নয় উন্মাদীয় চিন্তাভাবনা বলা যায়।