সাইফুল ইসলাম

রূপসা-শিপইয়ার্ড-খানজাহান আলী সেতু সড়কের দৈর্ঘ্য মাত্র পৌনে চার কিলোমিটার। মহানগরী খুলনায় প্রবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি চার লেনে উত্তীর্ণ করতে একটি প্রকল্প একনেকে পাশ হয়েছিল ২০১৩ সালে। এরপর পার হয়েছে এক যুগ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহবুব ব্রাদার্সের কাজে গাফিলতি আর বাস্তবায়নকারী সংস্থা খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষর (কেডিএ) যথাযথ তদারকির অভাবে গোটা সড়কটি মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় ধান চাষের জমিতে রূপ নেওয়া সড়কে দূর্ঘটনা ও জীবনহানি নিত্যদিনের ঘটনা। কেডিএ বাধ্য হয়ে ৭ আগস্ট মাহবুব ব্রাদার্সের সাথে চুক্তি বাতিল করেছে। তাতে ভোগান্তি কমেনি, বরং বেড়েছে অনিশ্চয়তা। তিক্ত বিরক্ত নগরবাসী মঙ্গলবার খানজাহান আলী ব্রিজ এলাকায় সড়ক অবরোধ করে কেডিএ’কে লাল কার্ড প্রদর্শণ করেছে। প্রতীকি প্রতিবাদ হিসেবে কর্দমাক্ত রাস্তায় রোপন করেছে ধানের চারা।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘আতাউর রহমান লিমিটেড অ্যান্ড মাহাবুব ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড (জয়েন্ট ভেঞ্চার) কে কার্যাদেশ দেয় কেডিএ। ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তাদের ৩ দশমিক ৭৭৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটি ৪ লেনে প্রশস্ত করে পুনঃনির্মাণ, দুই পাশে ড্রেন ও ফুটপাত, সড়কের মাঝে দশমিক ৯২ মিটার ডিভাইডার নির্মাণ, লবণচরায় ৬৬ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ এবং মতিয়াখালীতে স্লুইসগেট ও কালভার্ট নির্মাণের জন্য কথা ছিল। ইতোমধ্যে তারা ৭০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। কিন্তু অর্ধেকের বেশি কাজও শেষ হয়নি। বর্তমানে সড়কের বেজ টাইপ-২ (বর্তমান সড়কের ওপর পাথরের স্তর), বেজ টাইপ-১, ৪ ইঞ্চি বিটুমিনের কার্পেটিং (পিচের স্তর), তার ওপর সিলকোর্ট (বিটুমিনের আরেকটি স্তর) দেওয়া বাকি রয়েছে। এসব কাজের ব্যয় বেশি এবং মুনাফা কম। এর তুলনায় সড়কে মাটির নিচের বালু এবং ইটের টুকরা স্থাপনের কাজ লাভজনক, সহজ ও মুনাফা বেশি। লাভজনক অংশটুকু করে মুনাফা টাকা তুলে নিয়েছে মাহাবুব ব্রাদার্স।
একই অবস্থা লবণচরা সেতুর। ৬৬ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুর পাইলিং শেষ করেছে ঠিকাদার। ১০টি গার্ডারের মধ্যে মাত্র একটির কাজ শেষ হয়েছে। এখানেও মাটির নিচে লাভজনক কাজটুকু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মতিয়াখালীতে দুই স্তরের স্লুইচগেটের মধ্যে এক স্তর শেষ করেছে মাহাবুব ব্রাদার্স। অন্য স্তর স্থাপন না করায় জোয়ারের সময় ওই গেট দিয়ে শহরের ভেতরে পানি প্রবেশ করছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাস্তাটি ২০১৩ সাল পর্যন্ত খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২০১৩ সালের ৭ মে সড়কটি ৪ লেনে উন্নীত করণের জন্য একনেকে প্রকল্প অনুমোদন করায় খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)। প্রকল্প ব্যয় ছিল ৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এরপর থেকে সড়কটি কেডিএর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নানা জটিলতায় নির্ধারিত সময়ের ৯ বছর পর কাজ শুরু করে তারা।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি সড়কের কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্স। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। ফলে প্রকল্প সংশোধন করা হয়। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৫৯ কোটি টাকা।
দেখা গেছে, সড়কের পাশে রূপসা বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়, দাদা ম্যাচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শিপইয়ার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আল আমিন একাডেমি, লবণচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাজী মালেক দাখিল মাদ্রাসা, ইব্রাহিম ক্যাডেট মাদ্রাসা, সরকারি সালাউদ্দিন ইউসুফ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাজী মালেক কলেজ রয়েছে। সড়কের লবণচরা এলাকা অবস্থিত বান্দা বাজারে প্রায় ৪৫০টি দোকান রয়েছে। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে পণ্য আনা নেওয়া করতে না পারায় অসংখ্য ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছে। প্রথম দিকে রাস্তার দু’পাশে খাল কেটে ফেলে রেখেছিল দেড়বছর। তখনই কেনাবেচা বন্ধ হয়ে অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে।
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপ পরিচালক ও গণসংযোগ কর্মকর্তা মো: ইজাদুর রহমান জানান, ২০১৩ সালে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হলেও জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা, বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সাথে জমি সংক্রান্ত বিরোধ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ইত্যাদি ঝামেলা মিটিয়ে ২০২২ সালে ঠিকাদরকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। তবে শুরু থেকেই গাফিলতি ও বিলম্ব করায় বিভিন্ন সময়ে ১৪ টি ওয়ার্নিং লেটার দেওয়া হয়। এর মধ্যে খুলনা ওয়াসা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপনের জন্য কাজ শুরু করে।
তিনি বলেন, কাজে গাফিলতি, ধীরগতি ও শর্তভঙ্গ করায় ৭ আগস্ট মাহবুব ব্রাদার্সের সাথে চুক্তি বতিল করা হয়েছে। জনদূর্ভোগ বিবেচনায় দ্রুত অবশিষ্ট কাজ শুরুর জন্য ২৪ আগস্ট টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর টেন্ডার ওপেন করে দ্রুত ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হবে। তবে মাহবুব ব্রাদার্স ইতোমধ্যে জেলা জজ আদালতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামল্ াকরেছে। এতে কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন।
এদিকে মঙ্গলবার নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’র ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচিতে নাগরিক নেতা ও স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ জনদূর্ভোগের জন্য কেডিএ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উভয়কে সমান দায়ি করে দ্রুত সমস্যার সুরাহা না হলে এই দুটি প্রতিষ্ঠান ঘেরাও করা হবে বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহকারী মহাসচিব ও দৈনিক আমার দেশের খুলনা ব্যুরো প্রধান এহতেশামুল হক শাওন। নিসচার মহানগর সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান মুন্নার সঞ্চালনায় কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন শেখ মো. নাসির উদ্দিন।

