
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বর্তমানে অনেকাংশে ‘সামিট গ্রুপ’–নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ সেবার জন্য দেশের জনগণ কার্যত এই প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে আছে।
বিদ্যুৎ খাতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ দেওয়ার মাধ্যমে খাতটিকে পরনির্ভরশীল এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ স্বৈরশাসন। সামিট গ্রুপকে সুবিধা দিয়ে বিদ্যুৎ খাতে সৃষ্টি করা হয়েছিল এক প্রভাবশালী চক্র, যারা অবাধে লুটপাট চালিয়েছে বছরের পর বছর। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে সামিট গ্রুপ বিদ্যুৎ খাতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার করে। কে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প (কুইক রেন্টাল) পাবে, কোথা থেকে বিদ্যুৎ কেনা হবে—এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিত এই প্রতিষ্ঠান। প্রতিমন্ত্রী থেকে শুরু করে সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ ছিল কমিশন নেওয়া, দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার করা এবং ক্ষমতাসীনদের খুশি রাখা পর্যন্ত।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সামিট গ্রুপের কর্ণধার মুহাম্মদ আজিজ খান ও তাঁর মেয়ে আয়েশা আজিজ খান সরাসরি শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। আজিজ খান কোনো সাংবিধানিক পদে না থাকলেও দেশে এলে পেতেন ভিভিআইপি প্রটোকল। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবিধা নিয়েই সামিট গ্রুপ বিদ্যুৎ খাতে তাদের ব্যবসা প্রসারিত করে এবং কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
২০১০ সালে দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতির অজুহাতে দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন পাস করা হয়, যাতে টেন্ডার ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর একের পর এক অবাস্তব ও ব্যয়বহুল প্রকল্প অনুমোদন করা হয়, যেগুলোর অনেকগুলোই রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে সালমান এফ রহমান, নাহিম রাজ্জাকসহ ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতার প্রতিষ্ঠান সরাসরি প্রকল্প পেয়েছিল।
বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সামিট গ্রুপ সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে। গ্রুপটির প্রায় ২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মিলিত ক্ষমতা প্রায় ৩,০০০ মেগাওয়াট হলেও চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ফলে অনেক সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে তারা। শুধু ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্তই সামিট গ্রুপ ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৪,৪০৬ কোটি টাকারও বেশি অর্থ পেয়েছে, যা ওই সময়ের মোট ক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় ১৩ শতাংশ।
সামিট গ্রুপের মূল প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত সিঙ্গাপুরে হওয়ায় দেশ থেকে আয়ের বড় অংশ বাইরে চলে যায়, যা বিদেশে অর্থ পাচারের সুযোগও সৃষ্টি করেছে।
এছাড়া গ্যাস ও জ্বালানি খাতেও বিশেষ সুবিধা পেয়েছে সামিট। গ্যাস সংকট থাকা সত্ত্বেও নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আবার ২০১৩ সালে সামিট গ্রুপকে বছরে ১ লাখ টন ফার্নেস অয়েল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়, যা ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। এতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারের পথ তৈরি হয়।
এমনকি মহেশখালীতে নির্মিত দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের (FSRU) একটি সামিটকে দেওয়া হয় দরপত্র ছাড়াই। চুক্তি অনুযায়ী, টার্মিনাল অচল থাকলেও প্রতি মাসে প্রায় ৯০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দিতে হচ্ছে সরকারকে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার সামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে বড় ধরনের তদন্ত শুরু করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের ভিত্তিতে আদালত সামিটের ১৯১টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেছে, যেখানে প্রায় ৪২ কোটি টাকা রয়েছে। এছাড়া লুক্সেমবার্গে সামিট চেয়ারম্যান আজিজ খান ও তাঁর পরিবারের নামে থাকা ৪১ লাখ ইউরো (প্রায় ৫৬ কোটি টাকা) মূল্যের সম্পদও অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
দুদকের আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সামিট গ্রুপ ঘুষ, দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছে। তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়েছে যাতে বিদেশে পাচার বা গোপন করা না যায়।
এই তদন্তের ফলাফল প্রকাশ হলে বিদ্যুৎ খাতের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।

