চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যূত্থানে খুলনার ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন ছিল ২ আগস্ট। দিনটি ছিল শুক্রবার। জুম্মার নামাজের পর থেকে কয়েক দফা পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ ঘটে। পুলিশের ভয়াবহ মারমুখি আচরণ ও নির্বিচারে গুলি বর্ষণের মুখে রুখে দাঁড়ায় ছাত্র সমাজ। হাজারো শিক্ষার্থীর সাথে অজস্র অভিভাবক ও সাধারণ জনতা এসে দখল নেয় রাজপথের। মূলত সেদিনই খুলনা স্বাধীনতা অর্জন করে। ওই দিনের পর আর খুলনার রাজপথে পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখা যায়নি।
খুলনার জিরো পয়েন্ট ও গল্লামারী মোড় এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে অসংখ্য টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। শিক্ষার্থীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকল ছোড়ে। বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা পুলিশের একটি পিকআপে আগুন ধরিয়ে দেয়।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ (রাবার বুলেট ও শটগানের গুলি) অবস্থায় ৭ জনসহ ১৬ জনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে ৪ জনের অবস্থা গুরুতর থাকে। এ ঘটনায় পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হন। তাদের পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গুরুতর আহত একজন পুলিশের গাড়ি চালকের অবস্থা আশংকাজনক ছিল।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কর্মরতারা জানিয়েছিলেন, বিকেল থেকে সংঘর্ষে আহত রোগীরা হাসপাতালে আসেন। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সিরাজুল ইসলাম (৬০), শাহরিয়ার নীরব (২৪), আবির (২৪), মিজান (৪৮), ফাইয়াস (২৩), রবিনা (৩২), নাবিল (২৪), মিজান (৩২), সৌরভ (২৩), শেখ তানিক (২২), মিতু (২১), তানিয়া (১৯), রাবেয়া সুলতানা(২৩) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া আরো কয়েকজন ব্যক্তিগতভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কমপক্ষে ৭/৮ জনের শরীরে গুলি ছিল। বাকীরা টিয়ারসেল, রাবার বুলেট ও ইটের আঘাতে আহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শুক্রবার দুপুর দুইটার দিকে শিক্ষার্থীরা নিউমার্কেটের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এ সময় পুলিশ তাদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও পরে পিছু হটে। এরপর তারা মিছিল সহকারে মজিদ সরণি হয়ে সোনাডাঙ্গা থানার দিকে যায়। শিক্ষার্থীরা সোনাডাঙ্গা থানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। তখন পুলিশ সদস্যরা থানার ভেতরে গিয়ে অবস্থান নেয়। পরে হরিণটানা থানায়ও ইটপাটকেল ও খালি বোতল নিক্ষেপ করে তারা। এ সময় থানার প্রধান ফটক বন্ধ ছিল।
শিক্ষার্থীরা বেলা সোয়া ৩টার দিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছানোর পর পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল নিক্ষেপ এবং পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে চলে এই সংঘর্ষ। এছাড়া উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় নগরীর গল্লামারী থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
বিকাল ৪ টার দিকে পুলিশ কিছুটা পিছু হটে। কিছু পুলিশ জিরো পয়েন্ট এলাকায় এবং কিছু পুলিশ গল্লামারী মোড়ে অবস্থান নেয়। কয়েক দফা শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পুলিশ কিছুটা পেছনে সরে আসতে বাধ্য হয়।
পরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের পর শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে নগরীর শিববাড়ি মোড়ের দিকে যেতে চাইলে বিকাল ৬টায় গল্লামারী মোড়ে আরেকদফা সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ মুর্হুমূর্হু টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। সাড়ে ৬টার দিকে পুলিশ পিছু হটলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
খুলনায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। আরও বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। নিহত সুমন কুমার ঘরামী (৩৩) খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইন্সে কর্মরত ছিলেন। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটের দিকে গল্লামারী কাঁচাবাজারে এ ঘটনা ঘটে।
সেই দিনের ভয়াবহ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়মান আহাদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী এমন ভয়াবহতা খুলনার মানুষ আগে কখনো দেখেনি। সেদিন দেখেছি মানুষের ক্ষোভ এবং স্বৈরাচারের পতনের নেশা। রাস্তায় পুলিশের বাঁধা আর ভারি বর্ষণ কিছুই থামাতে পারেনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে বাম চোখ হারায় খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটির ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (ইইই) প্রথম বর্ষের ছাত্র আব্দুল্লাহ শাফিল। ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা করে শাফিল বলেন, পুলিশ বৃষ্টির মতো রাবার বুলেট ও ছররা গুলি ছুড়তে থাকে। এগুলো সহ্য করেও আমরা দুই সহযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাই। এ সময় একজন পুলিশ সদস্য মাটি কাটার ভেকুর পেছনে লুকিয়ে থাকেন তাকে আমি দেখতে পাইনি। আমি যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাই তিনি আমার মাথা বরাবর গুলি ছোড়েন। এতে আমার মুখে গলায় গুলি লাগে। একটা স্প্লিন্টার আমার চোখ ছিঁড়ে ভেতরের হাড়ে গেঁথে যায়। চোখের কর্ণিয়া, লেন্স এবং রেটিনা ছিঁড়ে জর্জরিত করে ফেলে। দেশ বিদেশের একাধিক চক্ষু হাসপাতালে দেখিয়েও লাভ হয়নি ।

