হৃদ্রোগ মানেই যে শুধু তীব্র বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি—এই ধারণাটা বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে প্রচলিত। অনেকেই মনে করেন হার্ট অ্যাটাক মানেই বুকের মাঝখানে চাপ অনুভব বা পাঁজরের ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়া ব্যথা। কেউ কেউ আবার এ ব্যথাকে গ্যাসের সমস্যা বা অম্বলের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, হার্ট অ্যাটাক হঠাৎ করে ঘটে না; অনেক বছর আগে থেকেই শরীর নানা সংকেত দিতে শুরু করে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন প্রকাশিত এক গবেষণা সেই বিষয়টিই আরও স্পষ্ট করেছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, হৃদ্যন্ত্রের বড় ধরনের সমস্যা, যেমন হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা হার্ট ফেইলিউরের ঝুঁকি যাঁদের মধ্যে রয়েছে, তাঁদের শরীরে প্রায় এক যুগ আগে থেকেই কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। সবচেয়ে সাধারণ পরিবর্তন হলো মাঝারি বা তীব্র মাত্রার শরীরচর্চার সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যাওয়া।
ঝুঁকির আগাম ইঙ্গিত
গবেষক দল প্রায় ৩,০৬৮ জন মানুষের স্বাস্থ্যতথ্য পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, যাঁরা পরবর্তীতে হার্ট অ্যাটাক, করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা হার্ট ফেইলিউরে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের শরীর ব্যায়াম সইবার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারাচ্ছিল। প্রায় ১২ বছর আগে থেকেই তাঁদের শারীরিক সক্ষমতার এই হ্রাস শুরু হয়েছিল এবং রোগ নির্ণয়ের দুই বছরের মধ্যে তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই তথ্য চিকিৎসকদের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সাধারণ মানুষের জন্যও সতর্কবার্তা। কারণ, শরীর যখন বারবার সংকেত দিচ্ছে, তখন সেটি উপেক্ষা করা মানে নিজেকে অজান্তে বড় ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া।
সব ক্লান্তি ভয়াবহ নয়
তবে যে কেউ যদি হঠাৎ শরীরচর্চা শুরু করেন, তাহলে প্রথম দিকে ক্লান্তি বা হাঁপ ধরা একেবারেই স্বাভাবিক বিষয়। তাই প্রাথমিকভাবে মাঝারি ব্যায়াম করলেই যদি অবসন্নতা বা অস্বস্তি হয়, সেটা আতঙ্কের কারণ নয়।
নিজেকে ধীরে ধীরে ব্যায়ামের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তুলুন। প্রয়োজনে প্রশিক্ষকের পরামর্শ নিন। একইভাবে কোনো একদিন অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়লে কিছুটা বিশ্রাম নিন, কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদী বিপদের ইঙ্গিত নয়।
তবে বিপদ তখনই যখন নিয়মিত ব্যায়ামের ধারাবাহিকতায় থেকেও যদি আপনার সহনশীলতা কমতে শুরু করে। অর্থাৎ, আগে যে ব্যায়াম অনায়াসে করতে পারতেন, তা হঠাৎই কষ্টকর মনে হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ জরুরি। এটি বয়সজনিত স্বাভাবিক পরিবর্তন, নাকি হৃদ্যন্ত্রের সমস্যার সংকেত—তা বুঝতে সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।
কোন ব্যায়াম মাঝারি, কোনটি তীব্র
গবেষণার মূল বিষয়টি বোঝার জন্য জানা জরুরি, কোন ব্যায়াম মাঝারি আর কোনটি তীব্র।
-
মাঝারি ব্যায়াম হলো এমন সব শরীরচর্চা যেখানে আপনার হৃদ্স্পন্দন এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের হার স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেড়ে যায়। সাধারণত ১০ মিনিট পর থেকে হালকা ঘাম ঝরতে শুরু করে। এ সময় কথা বলা সম্ভব হলেও গলার স্বর কিছুটা পরিবর্তিত হয়। যেমন—হালকা দৌড়, দ্রুত হাঁটা, সাইক্লিং, সাঁতার ইত্যাদি।
-
তীব্র ব্যায়াম হলো এমন সব শরীরচর্চা যেখানে হৃদ্স্পন্দন দ্রুত বেড়ে যায়, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘাম ঝরে পড়ে এবং শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। যেমন—উচ্চ গতির দৌড়, ভারী ব্যায়াম, স্প্রিন্ট সাইক্লিং, হাই ইন্টেনসিটি ওয়ার্কআউট ইত্যাদি।
সুস্থ থাকতে সপ্তাহে অন্তত কয়েকদিন এই দুই ধরনের ব্যায়ামের যেকোনো একটি বা উভয়ের সমন্বয় করা জরুরি, তবে শরীরের ওপর অযথা চাপ দেওয়া যাবে না।
কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন
হৃদ্স্বাস্থ্য রক্ষায় নিয়মিত ব্যায়ামের বিকল্প নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) বলছে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম অথবা অন্তত ৭৫ মিনিট তীব্র ব্যায়াম করা উচিত। চাইলে দুই ধরনের ব্যায়াম মিলিয়েও করা যায়। পাশাপাশি সপ্তাহে অন্তত দুদিন পেশি মজবুত করার ব্যায়াম করাও জরুরি।
তবে দীর্ঘ সময় একটানা ব্যায়ামের পরিবর্তে সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে ভাগ করে ব্যায়াম করা ভালো। যে ধরনের শরীরচর্চা উপভোগ্য মনে হয়, সেটি বেছে নেওয়া টেকসই অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
এ ছাড়া ব্যায়ামের বাইরে জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তনও হৃদ্স্বাস্থ্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। যেমন—
-
লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করা
-
কাছাকাছি গন্তব্যে হাঁটতে যাওয়া
-
দীর্ঘ সময় বসে না থাকা
শেষ কথা
হৃদ্রোগ হঠাৎ করে ঘটে না; শরীর বহু আগে থেকেই সংকেত দেয়। মাঝারি বা তীব্র মাত্রার ব্যায়ামে সক্ষমতা ক্রমশ কমে যাওয়া সেই সংকেতগুলোর একটি। এই পরিবর্তনগুলোর প্রতি নজর দিলে হার্ট অ্যাটাক বা বড় ধরনের হৃদ্রোগ হওয়ার অনেক বছর আগেই সচেতন হওয়া সম্ভব।
নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা শুধু হৃদ্স্বাস্থ্য রক্ষা করে না, বরং আপনাকে বুঝতেও সাহায্য করে—আপনার শরীর কোথাও কোনো অস্বাভাবিক ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না। সতর্ক হন, কারণ হৃদ্যন্ত্রের যত্ন নেওয়া শুরু হয় আজ থেকেই, কাল থেকে নয়।

